ইসলাম ও গণতান্ত্রের মাঝে পার্থক্য।

 



আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে পূর্ণতা দান করেছেন।

এরশাদ হয়েছে 

اليوم أكملت لكم دينكم واكملت عليكم نعمتى رضيت لكم الاسلام دينا

আমি আজ আপনাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম,আমার নিয়ামত তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে পছন্দ করে নিলাম।

তিনি মুমিনদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন পরিপূর্ণভাবে ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করতে বলেছেন

বলেছেন ادخلوا فيالسلم كافة

নিষেধাজ্ঞা জারী করেছেন অন্য দ্বীন অন্বেষণ করতে। বলেছেন 

ومن يبتغ غير الاسلام دينا فلن يقبل منه

যারা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন অন্বেষণ করবে,তা গ্রহণ করা হবে। আখেরাতে তারা বিপদগ্রস্ত বলে বিবেচিত হবে।




আধুনিক কালের পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসী জোয়ারকে যৌক্তিক ভাবে মোকাবিলায় অক্ষম এক শ্রেণীর ইসলামী চিন্তাবিদ এক সময় সমাজতন্ত্র নামক বিজাতীয় মতাদর্শকে কিছুটা সংস্কার করে ইসলামের মধ্যে গ্রহণ করার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। বর্তমানেও ঐ মানসিকতার ইসলামী চিন্তাবিদগণ মানব রচিত গণতন্ত্রকে ইসলামের মধ্যে আত্মীকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।


 তারা বলছেন, শুধু সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গটি বাদ দিলে গণতন্ত্রকে ইসলামের মধ্যে গ্রহণে কোন সমস্যা নেই। 

তাহলে আসুন আজ আমরা এ বিষয়টিকে একটু খতিয়ে দেখি ।

     গণতন্ত্র একটি মানব রচিত ধর্মহীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা। তবে ‘জনগণের শাসন ব্যবস্থা’ বা জনগণের সরকার ব্যবস্থা হিসাবেই এটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইংরেজী Democracy শব্দের বাংলা অর্থ গণতন্ত্র।

সাধারণভাবে গণতন্ত্র বলতে বুঝায়, এমন এক মতবাদ বা ব্যবস্থাকে যেখানে সমাজ-রাষ্ট্রের আইন-বিধান প্রণয়ণের চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয় জনগণের উপর বা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর। মোটকথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে শাসন কার্য পরিচালনাকে গণতন্ত্র বলে।

গণতন্ত্র ও ইসলামের প্রথম পার্থক্য হলো ,

গণতন্ত্র একটি মানব রচিত মতবাদ। গণ মানুষের ইচ্ছা বা আইন অনুসারে পরিচালিত হয় বলেই এর রাষ্ট্র বা শাসন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা হয়। অন্যদিকে ইসলাম আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহর খলীফা হিসাবে এবং তাঁর ইচ্ছানুসারে পরিচালিত হয় বলে ইসলামের শাসন ব্যবস্থাকে খিলাফত বলা হয়।

গণতন্ত্র মানব রচিত মতবাদ। পক্ষান্তরে ‘খেলাফত’ আল্লাহর অনুমোদিত শাসন ব্যবস্থার নাম।

গণতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব মানা হয়, যা স্পষ্ট শির্ক। পক্ষান্তরে ইসলামের খিলাফতি রাষ্ট্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানা হয়, যা তাওহীদের অন্তর্ভুক্ত।

গণতন্ত্রের মূল কথা জনগণের সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ সকল ক্ষমতার মালিক সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। একথা নিঃসন্দেহে শিরক। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَمْ يَكُنْ لَهُ شَرِيْكٌ فِي الْمُلْكِ ‘রাজত্বে তাঁর কোন শরীক নেই’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১১১)। তিনি আরো বলেন, قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ ‘তুমি বল, হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন’ (আলে ইমরান ৩/২৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘বরকতময় তিনি যার হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব। আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান’ (মূলক ৬৭/১)।


মহান আল্লাহ আরো বলেন,الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَمْ يَكُنْ ‘যার হাতে রয়েছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব। যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেন না এবং তাঁর রাজত্বে কোন শরীক নেই’ (ফুরক্বান ২৫/২)।


আল্লাহর বাণী থেকে বুঝা গেল আল্লাহই সকল ক্ষমতার মালিক। মানুষকে ক্ষমতার মালিক বা উৎস বানানো তাঁর সাথে শরীক স্থাপনের শামিল, যা স্পষ্ট শিরক।

     গণতন্ত্র ও ইসলামের দ্বিতীয় পার্থক্য হলো 

আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে : গণতন্ত্রে আইন-বিধান রচনার চূড়ান্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয় পার্লামেন্ট সদস্যদের উপর। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যেটা বলবে, যে বিষয়ে সম্মত হবে সেটাই হবে দেশের সর্বোচ্চ আইন, যার বিরোধিতা করা আইনত অপরাধ। 


বাংলাদেশের 7ম ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,"জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধানের সর্বোচ্চ আইন , এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামাঞ্জোস হয়,তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামাঞ্জস্যপূর্ন , ততখানি বাতিল হইবে।"


গণতন্ত্রে সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কুরআন-সুন্নাহর উপরে স্থান দেওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন তৈরী করতে পারে, এমনকি আল্লাহর আইনকে বাতিলও করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- পতিতাবৃত্তির লাইসেন্স দেওয়া, মদের লাইসেন্স দেওয়া, সূদের বৈধতা দেওয়া, ১৮ বছরের পূর্বে বিয়ে নিষিদ্ধ করা, ১৬ বছর বয়স পারস্পরিক সম্মতিতে যেনা করলে তার বৈধতা দেওয়া, স্বামীর অনুমতিতে স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে ব্যভিচার করলে তার বৈধতা দেওয়া, যাত্রা, সিনেমাহলে প্রকাশ্যে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতার চর্চাকে অনুমোদন দেওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের নীতিমালা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বরুবিয়্যাতের (ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের) ক্ষেত্রে শিরক এবং স্পষ্ট কুফরী। কেননা আল্লাহ বলেন, اَلَا لَهُُ الْخَلْقُ وَالْاَمْرُ ‘শুনে রাখ! সৃষ্টি যার হুকুম চলবে তার’ (আ‘রাফ ৭/৫৪)।


তিনি আরো বলেন,إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ- ‘আল্লাহ ব্যতীত কারু বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ব্যতীত তোমরা অন্য কারু ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’ (ইউসুফ ১২/৪০)।

(৩) বিরোধ মিমাংসার ক্ষেত্রে : গণতন্ত্রে যেকোন মতবিরোধ বা বিতর্কের চূড়ান্ত মিমাংসাকারী বানানো হয় সংবিধান ও এর ধারা সমূহ এবং পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে। এটা একটা স্পষ্ট কুফরী। মহান আল্লাহ বলেন,فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا- ‘অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)।


তিনি আরো বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে ব্যক্তি স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।

গণতন্ত্র কেন জাহেলিয়াত?


গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্য ন্যায়-নিষ্ঠতা, জ্ঞান-গরীমা, সততা, আল্লাহভীরুতার কোনই শর্ত নেই। যেকোন নাস্তিক, কাফির, ফাসিক-ফাজির, নির্বোধ-জাহেল ব্যক্তি পার্লামেন্ট সদস্য হ’তে পারে টাকার জোরে বা দলীয় আনুগত্য বিবেচনায়। ফলে এসব সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে জাহেলী আইন-কানূন প্রণয়ন করে।


গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটার হওয়ার জন্যও সততা, ন্যায়পরায়ণতা, জ্ঞানী-গুণী হওয়ার শর্তারোপ করা হয় না। ফলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাহেল লোকদের ভোটে শরী‘আত সম্পর্কে অজ্ঞরাই সাধারণত নেতা নির্বাচিত হয়। এজন্য গণতন্ত্রকে অনেক মনীষী মূর্খদের শাসন বলেছেন।


১. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক প্লেটো গণতন্ত্র সম্পর্কে বলেছেন, ‘বুদ্ধিমানের চেয়ে মূর্খ ও অবিবেচকের সংখ্যা অধিক। সুতরাং সংখ্যাধিক্যের শাসন বলে এটা প্রকারান্তরে মূর্খের শাসন।[7]


২. জন লেকি বলেন, ‘গণতন্ত্র দারিদ্র্য পীড়িত, অজ্ঞতম ও সর্বাপেক্ষা অক্ষমদের শাসন ব্যবস্থা; কারণ তারাই রাষ্ট্রে সংখ্যায় সর্বাপেক্ষা অধিক।[8]


৩. মিশরীয় ইসলামিক স্কলার মুহাম্মাদ কুতুব বলেন, আল্লাহর দাঁড়িপাল্লায় বিধান হ’ল দু’টি। একটি হ’ল আল্লাহর বিধান অপরটি জাহেলিয়াতের বিধান (মায়েদাহ ৫০)। গণতন্ত্র আল্লাহর বিধান নয়। সুতরাং তা আল্লাহর মাপকাঠিতে জাহেলিয়াতের বিধান।

মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) বলেন, ‘মোটকথা ইসলামের মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসন নামে কোন কিছু নেই। এই নব আবিষ্কৃত তথাকথিত গণতন্ত্র শুধু একটি বানানো প্রতারণার বস্ত্ত। বিশেষ করে এমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যা মুসলিম এবং কাফের শাসকদে

র সমন্বয়ে গঠিত, অনৈসলামিক রাষ্ট্র ছাড়া আর কী হবে?








একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ